সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে গোপন আঁতাত করে ৬টি উন্নয়ন কাজ ভাগিয়ে নিয়েছেন ছয়টি ভাগ্যবান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ ঘটনায় টেন্ডারে অংশ নিয়ে অনিয়ম জালিয়াতির কারণে উন্নয়ন কাজ বঞ্চিত অপরাপর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের মাঝে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন, এখানে ঠিকাদারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা মূলক মূল্য বসানো হয়নি। এঅবস্থার কারণে সরকরকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। জালিয়াতির ঘটনাটি তদন্ত পুর্বক এসব উন্নয়ন কাজের টেন্ডার বাতিল করে পুনরায় দরপত্র আহ্বানের দাবি জানিয়েছেন।
অভিযোগ উঠেছে, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (ডিএফও) আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ তাঁর কার্যালয়ের অধস্তন কতিপয় দুর্নীতিবাজ কমর্কর্তার মাধ্যমে মোটা অঙ্কের লেনদেনের বিনিময়ে সরকারি গোপন টেন্ডার মুল্য তাঁর পছন্দের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের কাছে আগেভাগে ফাঁস করে দেয়ায় এসব উন্নয়ন কাজের টেন্ডার প্রতিযোগিতায় রীতিমতো জালিয়াতির এই কান্ডটি ঘটেছে। গতমাসে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজের বিপরীতে চট্টগ্রাম বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের ডিএফও আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ টেন্ডার আহবান করেন।
চলতি মাসের ৫মে দুপুর বারোটায় দরপত্র জমাদান এবং খোলার শেষ তারিখ ও সময় দরপত্রে উল্লেখ্য করা হয়েছে। ওইদিন ৬টি উন্নয়ন কাজের বিপরীতে টেন্ডারের মাধ্যমে নির্বাচিত ছয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, প্যাকেজ নম্বর ২০২৪/২০২৫/ ডাবিউ পি/০১ টেন্ডারের বিপরীতে বাউন্ডারি ওয়াল গেইট নির্মাণ কাজটি ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮০ টাকায় পেয়েছেন ভাগ্যবান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মাছুম বিল্ডার্স।
দরপত্রে ওই কাজের সরকারি মুল্য ছিল ৩৯ লাখ ৬৪ হাজার ২০০ টাকা। টেন্ডার কমিটির চেয়ারম্যান তথা প্রতিষ্ঠানটির প্রধানের (বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের ডিএফও) উপর অর্পিত ক্ষমতাবলে ওই কাজের মোট টেন্ডার মুল্য থেকে ১০ পার্সেন্ট মুল্য বাদ (লেজ) দিয়ে কাজের প্রকৃত মুল্য দাঁড়ায় ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮০ টাকা। সরকারি গোপন মুল্যের সঙ্গে সংগতি রেখে উল্লেখিত ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮০ টাকার বিপরীতে দরপত্র দাখিল করে কাকতালীয় ভাবে তিনিই কাজটি পেয়ে গেছেন। অথচ ওই কাজটি পেতে টেন্ডারে অংশ নিয়েছেন মোট ১০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তাদের মধ্যে মুজাহিদ ফাউন্ডেশন ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৭৯ টাকা ৪২১ পয়সা, মেসার্স মাছুম বিল্ডার্স ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮০ টাকা, মেসার্স নজর“ল কনস্ট্রাকশন ৩৬ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮০ টাকা ৯০০ পয়সা, মেসার্স রহিমা এন্টারপ্রাইজ ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮১ টাকা ৯০০ পয়সা, মেসার্স বিসমিল্লাহ ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮৫ টাকা ৫৫০ পয়সা, র“পকার ৩৫ লাখ ৯৫ হাজার ১০৪ টাকা ৫৩৪ পয়সা, মেসার্স জিয়া এন্টারপ্রাইজ ৩৫ লাখ ৯৬ হাজার ৭৫৭ টাকা ৬৭০ পয়সা, মেসার্স আরএন এন্টারপ্রাইজ ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার ৫৭ টাকা ৮৭০ পয়সা, মেসার্স আবুল হাশেম ভূইয়া ৩৬ লাখ ১৪ হাজার ৯৯৯ টাকা ৪৫৩ পয়সা এবং দি এডি কনস্ট্রাকশন ৩৯ লাখ ৭৪ হাজার ৫০০ টাকা কাজটি পেতে দরপত্রে উল্লিখিত টেন্ডার মুল্য দিয়ে কাগজপত্র দাখিল করেন।
সেখানে সরকারি গোপন মুল্যের সঙ্গে দরপত্র মুল্য ঠিক করে টেন্ডারে অংশ নিয়ে ভাগ্যবান ঠিকাদার হিসেবে মেসার্স মাছুম বিল্ডার্স ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮০ টাকার বিপরীতে কাজটি পেয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিটি টেন্ডারে ৮/১০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজের বিপরীতে বিভিন্ন দরপত্র মুল্যে অংশ নিলেও ডিএফও কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে টেন্ডার জালিয়াতির মাধ্যমে মোট ৬টি উন্নয়ন কাজ এভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন ভাগ্যবান ৬টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। মেসার্স মাছুম বিল্ডার্স ছাড়াও জালিয়াতির মাধ্যমে ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজের টেন্ডার ভাগাভাগি কান্ডে সুযোগ পেয়েছেন মেসার্স করিম এন্ড বাদ্রার্স। এই প্রতিষ্ঠানটি সরকারি গোপন মুল্য মিলিয়ে ১ কোটি ৬৬ লাখ ৩১হাজার ০০১ টাকার বিপরীতে কিপার গ্যালারি নির্মাণ কাজ পেয়েছেন।
অনুরূপভাবে ৩৫ লাখ ৮৭ হাজার ৭৬৯ টাকার বিপরীতে এক্সচেঞ্জ রোড নেটওয়ার্ক ভেতরে বাইরে গেইট নির্মাণ কাজ পেয়েছেন মেসার্স এডি কনস্ট্রাকশন। ২২ লাখ ৩৫ হাজার ৩১৬ টাকা ৫০ পয়সার বিপরীতে বন্যপ্রাণীর খাদ্য সরবরাহের ঘর তৈরির কাজ পেয়েছেন মেসার্স রহিমা এন্টারপ্রাইজ। ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার ২২৩ টাকা ৪০ পয়সার বিপরীতে প্রাণীর ঘর নির্মাণ কাজ পেয়েছেন ফ্রেন্ডস ইঞ্জিনিয়ারিং। ৪৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫১৮ টাকা ৫০ পয়সার বিপরীতে আর্বজনা ফেলার স্থান (ডাম্পিং স্টেশন) নির্মাণ কাজ পেয়েছেন মুজাহিদ ফাউন্ডেশন।
অভিযোগ উঠেছে, বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (ডিএফও) আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াসিন নেওয়াজ এর যোগসাজশে টেন্ডার জালিয়াতির সঙ্গে ডিএফও অফিসের টেন্ডার কমিটির সভাপতি বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা বেগম নূর জাহান এবং অপর বন্যপাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা দীপান্বিতা ভট্টাচার্য এবং ডিএফও কার্যালয়ের পুরোনো স্টাফ আরিফ আহমেদ এর নেতৃত্বে একটি চক্র জড়িত রয়েছেন। বর্তমানে সাফারি পার্কের উন্নয়ন কাজ ভাগিয়ে নেওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গুলোর সংশ্লিষ্টরা প্রতিদিন চট্টগ্রামস্থ বিভাগীয় বনকর্মকর্তার কার্যালয়ে কাজের ওয়ার্ক অর্ডার পেতে ব্যাপকভাবে তোড়জোড় চালাচ্ছে। ডিএফও কার্যালয়ের পুরানো স্টাফ (অনিয়ম দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড) হিসেবে পরিচিত আরিফ আহমেদ এর অর্থপুর্ণ উদারতার মাধ্যমে ডিএফও আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজের কাছ থেকে ঠিকাদারদের কাজের ওয়ার্কঅর্ডার নিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করেছেন জালিয়াতিকান্ডের কারণে প্রতারণার শিকার একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন।
টেন্ডার জালিয়াতির অভিযোগ বিষয়ে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (ডিএফও) এবং ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ ওয়াটসাপ এ প্রশ্নের উত্তর লিখেছেন টেন্ডার জালিয়াতির কোন ঘটনা এখানে ঘটেনি। আমি বাঁশখালী বনাঞ্চলে আছি। নেট ওয়ার্ক সমসা আছে, ধন্যবাদ। পরে অবশ্য তিনি আর বিষয়টি নিয়ে কিছুই বলেননি।
পাঠকের মতামত: